অনলাইন ডেক্স:
ভারতের হিমাচল প্রদেশের সিরমৌর জেলার সিরমৌরের শিলাই গ্রামেরই দুই ভাই প্রদীপ নেগি ও কপিল নেগিকে একইসঙ্গে বিয়ে করেছেন সুনিতা চৌহান নামে এক নারী। তফসিলি
জনজাতি হিসেবে নথিভুক্ত হাটি সম্প্রদায়ের পুরোনো বহুপতিত্ব প্রথা মেনেই
এই বিয়ে। স্থানীয় ভাষায় একে 'জোড়িদারা' বা 'জাজড়া' বলা হয়।
সিরমৌরের
ট্রান্স-গিরি এলাকায় আয়োজিত এই বিয়ের অনুষ্ঠানে দুই পক্ষের
আত্মীয়স্বজনরা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন শত শত গ্রামবাসী। বিয়েতে ঐতিহ্যবাহী
লোকগান, নাচ আর ব্যঞ্জনের সমারোহ ছিল।
হাটি সম্প্রদায়ের পুরোনো প্রথা মেনে এই বিয়ে হলেও বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে এই রীতি নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে।
বিবিসি ওই তিনজনের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। কিন্তু একাধিকবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তারা কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
পাত্র-পাত্রীরা অবশ্য জানিয়েছেন, তাদের সম্মতিতেই বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে।
কী এই প্রথা?
পাত্রী
সুনিতা চৌহানের পরিবার সিরমৌর জেলার কুঁহাট গ্রামের বাসিন্দা। পাত্রদের
গ্রাম শিলাই থেকে কুঁহাটের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। শিমলা থেকে প্রায়
১৩০ কিলোমিটার দূরে ওই অঞ্চল।
পাত্র
এবং পাত্রী দুই পক্ষের পরিবারই হাটি সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। সিরমৌর জেলার
ট্রান্স-গিরি অঞ্চল ছাড়াও হাটি সম্প্রদায়ের মানুষ উত্তরাখণ্ডের
জৌনসার-বাওয়ার এবং রাওয়াই-জৌনপুর অঞ্চলে বসবাস করেন।
এই সম্প্রদায়ের মধ্যে বহুপতিত্ব বা এক নারীর একাধিক স্বামী গ্রহণের রেওয়াজ দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত রয়েছে।
এই
প্রথা মেনে, হাটি সম্প্রদায়ের নারীরা একই পরিবারের দুই বা তার বেশি ভাইকে
বিয়ে করতে পারেন। এই বিয়ে পরিবারের সম্মতিক্রমে হয় এবং বাড়ির দায় দায়িত্ব
নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধরা।
সিরমৌর ছাড়াও সিমলা, কিন্নর এবং লাহুল স্পিতির কিছু অংশেও এই প্রথা মেনে বিয়ে হয়।
কেন এই প্রথার চল?
যারা এই প্রথা সম্পর্কে অবগত, তাদের মতে এর নেপথ্যে বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। পরিবারের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য বজায় রাখা এবং পৈতৃক সম্পত্তির বিভাজন হওয়া থেকে রোধ করাই ছিল এই প্রথার লক্ষ্য। স্থানীয়
বাসিন্দা কপিল চৌহান বলেন, "জোড়িদারা প্রথা আমাদের পরিচয়। এই প্রথা
সম্পত্তির বিভাজন রোধ করতে, যৌতুক প্রথা এড়াতে, ভাইদের মধ্যে ঐক্য বজায়
রাখতে এবং সন্তান লালন-পালন করতে সাহায্য করে।" তিনি জানিয়েছেন শিলাই এলাকার প্রায় প্রতিটা গ্রামেই চারটে থেকে ছয়টা পরিবার এই প্রথা অনুসরণ করে। সুনিতা
চৌহানের সঙ্গে কপিল নেগি ও প্রদীপ নেগির বিয়ে নিয়ে যে ধরনের আলোচনা হচ্ছে,
সে সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেন, "আমি বহুদিন ধরেই এই
বিষয়ে জানতাম। এই ঘটনা হঠাৎ ঘটেনি। এটা আমাদের একটা প্রথাগত ঐতিহ্য। আমাদের
জন্য এটা গর্বের বিষয়।" "যতক্ষণ পর্যন্ত পাত্ররা, পাত্রী এবং তাদের পরিবার এতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে ততক্ষণ অন্য কারো এতে কিছু বলার নেই।"তিনি আরও বলেন, "বিষয়টা স্বীকার করে নেওয়া উচিত। এখন তো মানুষ লিভ-ইন রিলেশনশিপের বিষয়ও সহজে মেনে নেন।" গত ১২ জুলাই থেকে বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল। দুই পাত্র এবং পাত্রী, তিনজনেই শিক্ষিত। সুনীতা চৌহান আইটিআই থেকে পড়াশোনা করেছেন। প্রদীপ নেগি রাজ্য সরকারের জলশক্তি বিভাগে কর্মরত এবং কপিল নেগি বিদেশে হসপিটালিটি সেক্টরে কাজ করেন।
বিয়ের
বিষয়ে বিবিসি হিন্দিকে সুনিতা চৌহান বলেছেন, "এটা আমার নিজের সিদ্ধান্ত
ছিল। এই ঐতিহ্য সম্পর্কে আমি অবগত ছিলাম এবং আমি সেটা মেনে চলেছি।" একই কথা জানিয়েছেন প্রদীপ নেগিও। তার কথায়, "আমাদের সংস্কৃতিতে, এই সম্পর্ক বিশ্বাস, যত্ন এবং দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার।"
বিদেশে
কর্মরত হলেও এই প্রতিশ্রুতি মেনে চলার বিষয়ে যে তিনি বদ্ধপরিকর সে কথা
জানিয়েছেন প্রদীপ নেগি। তিনি বলেছেন, "বিদেশে থাকলেও আমি এই সম্পর্কের
প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমার স্ত্রীকে স্থিতিশীলতা ও ভালোবাসা দিতে চাই।" এই
বিয়ের রীতি নীতি একটু আলাদা। জোড়িদারা রীতি মেনে, বিয়ের জন্য মেয়ের বাড়ি
থেকে বরের বাড়িতে কন্যাযাত্রীরা যায়। ঐতিহ্যবাহী রামলাসার পূজার রীতি
মেনেই এই বিয়ে সম্পন্ন হয়।
এই
পদ্ধতিতে, সাতপাকে ঘোরার বদলে অন্য নিয়ম মানা হয়। একে 'সিঞ্জ' বলে। এই
নিয়ম মেনে আগুনের চারপাশে পাক না দিয়ে আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে একে অন্যকে
প্রতিশ্রুতি দেন পাত্র-পাত্রী।
ওয়াজিব-উল-আরজ ও আইনগত স্বীকৃতি
হিমাচল
প্রদেশে, 'ওয়াজিব-উল-আরজ' নামে ঔপনিবেশিক যুগের এক রাজস্ব নথিতে
'জোড়িদারা' ব্যবস্থা লিপিবদ্ধ রয়েছে। এই দলিলে গ্রামের সামাজিক ও
অর্থনৈতিক রীতিনীতি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এবং ওই প্রথাকে হাটি সম্প্রদায়ের
ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে।
বলা হয় যে, কৃষিজমির বিভাজন বন্ধ করা এবং পরিবারকে ঐক্যবদ্ধ রাখাই এই প্রথার উদ্দেশ্য ছিল।
অন্যদিকে, হিন্দু বিবাহ আইন কিন্তু একটাই বিবাহকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দেয়, যা এই জাতীয় বিবাহের আইনি বৈধতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছে।
হিমাচল
প্রদেশ হাইকোর্টের আইনজীবী সুশীল গৌতম বিবিসি হিন্দিকে বলেছেন, "যেহেতু
দু'টো বিয়ে একইসঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে, তাই ১৯৫৫ সালের হিন্দু বিবাহ আইনের ৫
নম্বর ধারা এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩২ ধারা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।"
ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ভিত্তি
ট্রান্স-গিরি অঞ্চলের সঙ্গে 'জোড়িদারা' প্রথার যোগ বেশ গভীর বলে মনে করা হয়।
এই প্রথাকে জুড়ে দেওয়া হয় মহাভারতের দ্রৌপদীর কাহিনীর সঙ্গেও। যে কারণে অনেকে এটকে 'দ্রৌপদী প্রথা'ও বলে থাকেন।
হিমাচল
প্রদেশের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ড. ওয়াই এস পারমার তার বই 'পলিয়ান্ড্রি ইন
দ্য হিমালয়াস'-এ 'জোড়িদার' প্রথার সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ সম্পর্কে
বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন।
ওই
বইয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, "এই প্রচলন শুরু হয়েছিল পার্বত্য অঞ্চলে
বিদ্যমান কঠিন পরিস্থিতিতে যেখানে সীমিত কৃষিজমিকে একত্রিত করার
প্রয়োজনীয় ছিল।"
হাটি
সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত পণ্ডিত ও সমাজকর্মী আমিচাঁদ হাটি বলেন, "এই
প্রথার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে এবং এটা সম্প্রদায়ের ঐক্য ও ঐতিহ্যকে
প্রতিফলিত করে। একে সম্প্রদায়ের মূল্যবোধের সংরক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা
উচিত।"
কেন্দ্রীয় হাটি কমিটির সাধারণ সম্পাদক কুন্দন সিং শাস্ত্রী বলছেন, এই প্রথা বহু পুরনো। পরিবারের ঐক্য বজায় রাখাই এর উদ্দেশ্য।
বিতর্ক ও সমালোচনা
ট্রান্স-গিরি
অঞ্চলের এই বিয়ের কথা প্রকাশ্যে আসার পর বিতর্কও শুরু হয়েছে। একদিকে যেমন
কেউ কেউ একে সম্মতি এবং ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয় হিসেবে দেখছেন, অনেকে
আবার একে নারী অধিকারের বিরুদ্ধে বলে মনে করেন।
একাধিক সংগঠন এর বিরোধিতাও করেছে।
'অল
ইন্ডিয়া ডেমোক্রেটিক ওমেন্স অ্যাসোসিয়েশন'-এর সাধারণ সম্পাদক মরিয়ম
ধাওয়ালে বলেন, "নারীদের শোষণকে উৎসাহিত করে এই প্রথা। তাদের মৌলিক অধিকারও
লঙ্ঘন করে।"
হিমাচল প্রদেশের সিপিআই (এম) প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক ড. ওঙ্কার শাদও একে সংবিধান এবং আইনবিরোধী হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।
হিমাচল
প্রদেশের শিল্পমন্ত্রী তথা শিল্লাই-এর বিধায়ক হর্ষবর্ধন চৌহান বলেন, "এটা
শিলাইয়ের পুরনো ঐতিহ্য। প্রদীপ ও কপিল এই প্রথাকে বাঁচিয়ে রেখে নিজেদের
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।"
বিয়ে নিয়ে হাটি সম্প্রদায়ের অন্যান্য প্রথা
হাটি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে আরও চার ধরনের বিয়ের প্রথা প্রচলিত রয়েছে।
বাল বিবাহ- এক্ষেত্রে গর্ভাবস্থাতেই সন্তানের বিয়ে স্থির করে দেওয়া হয়। তবে বিয়ে হয় বড় হওয়ার পর সম্মতি নিয়ে।
জাজড়া-
এই প্রথায় বিয়ের প্রস্তাব আসে বরপক্ষের তরফ থেকে। সম্মতি পাওয়ার পর বিয়ের
আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। এই প্রথাতে 'সিঞ্জ'-এর চল রয়েছে।
ক্ষিতাইয়ো- বিবাহিত নারী তার শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে আবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে তাকে ক্ষিতাইয়ো বলে।
হার বিবাহ- যখন পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নারী কোনো পুরুষকে বিয়ে করলে তাকে হার বিবাহ বলে।
হাটি সম্প্রদায়
এই সম্প্রদায়ের মোট জনসংখ্যা সম্পর্কে কোনো সরকারি তথ্য নেই।
কিন্তু
কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে যখন তফসিলি জনজাতির তালিকায় এই সম্প্রদায়কে
অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানানো হয়, তখন এদের আনুমানিক জনসংখ্যা ছিল আড়াই
থেকে তিন লক্ষ।
এর মধ্যে সিরমৌরের ট্রান্স-গিরি অঞ্চলেই প্রায় দেড় থেকে দুই লক্ষ মানুষ রয়েছেন।
সিরমৌর
জেলার দেড়শোরও বেশি গ্রাম পঞ্চায়েত গিরিপাড় অঞ্চলের অন্তর্গত।
সম্প্রদায়ের কেউ কেউ জানিয়েছেন, এই এলাকায় কখনোই কোনো স্থায়ী বাজার ছিল
না। আশেপাশের এলাকা থেকে লোকজন ওই এলাকায় এসে অস্থায়ী হাট বসাতেন। এইভাবেই
এক সময় ওই সম্প্রদায়ের হাটি নামে পরিচিত হয়।
সমাজকর্মী
রমেশ সিংটার মতে, হাটি নামটা স্থানীয় হাট বাজারে গৃহস্থালীর পণ্য বিক্রির
পুরানো ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত। উত্তরাখণ্ডের হাটি সম্প্রদায়কে জৌনসারি
সম্প্রদায়ের অংশ বলে মনে করা হয় এবং তাদের ঐতিহ্যগত মিলও রয়েছে।
কেন্দ্রীয়
সরকার হিমাচল প্রদেশের হাটি সম্প্রদায়কে তফসিলি জনজাতির মর্যাদা দিয়েছে।
তবে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে হিমাচল প্রদেশের হাইকোর্ট গিরিপাড় তফসিলি
জাতি সুরক্ষা সমিতির দায়ের করা আবেদনের ভিত্তিতে সেই সিদ্ধান্তে
স্থগিতাদেশ দেয়।
ওই
সমিতির বক্তব্য হাটি সম্প্রদায়কে 'এসটি' (শিডিউল ট্রাইব) মর্যাদা দেওয়া
হলে বিদ্যমান সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রভাবিত হতে পারে এবং তা তফসিলি জাতির
অধিকারকেও প্রভাবিত করতে পারে।
তবে এই সম্প্রদায় তফসিলি জনজাতির মর্যাদা পেলেও তার সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না।
অন্যদিকে, ১৯৬৭ সালে উত্তরাখণ্ডের হাটি সম্প্রদায়কে কিন্তু তফসিলি জনজাতির মর্যাদা দেওয়া হয়।